১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
মনপুরা’৭০ একটি শিল্পকর্ম। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় উত্তর মনপুরা ঘুরে ঘূর্ণিঝড়ের বিধ্বংসী ও ধ্বংসাত্মক প্রভাবকে ২৮ ফুট লম্বা চিত্রকর্মে চিত্রিত করেন।
উপকূলীয় দ্বীপচরসহ বহু এলাকার ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে বিরান জনপদে পরিণত হয়। যেখানে যান, খালি গরু-মানুষ শুইয়া রইছে।’ সাগর-নদী-খাল-বিলে ভেসে ছিল অসংখ্য লাশ। মৃতদেহের সৎকার করাও সম্ভব হয়নি। ঘরবাড়ি, স্বজন হারিয়ে পথে বসেন উপকূলের লাখ লাখ মানুষ। এই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা আজও অনেকে শিউরে উঠেন।
জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা এ ঘূর্ণিঝড়কে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করেছে। ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস পূর্ববঙ্গের মানুষের ভাগ্য বদলের অন্যতম নিয়ামক হয়ে উঠে। ত্বরান্বিত করে মুক্তি সংগ্রামের। পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমানা পৃথক করে দেয়। ইতিহাস পরম্পরায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের সূতিকাগার আর ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পেরেকও। এ কারণেই ৫২-এ আমরা পেয়েছি “শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস”। ১২ নভেম্বরকে “উপকূল দিবস” ও “বিশ্ব উপকূল দিবস” দাবি প্রতিষ্ঠিত হলে আরও একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসের সাথে সম্পৃক্ত হব আমরা।
উপকূলের সংকট, সমস্যা, সম্ভাবনা এবং উপকূলের মানুষের অধিকার ও ন্যায্যতার দাবি আদায়ে উপকূলের জন্য একটি বিশেষ দিন অপরিহার্য। কেননা উপকূলের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, উপকূলকে প্রাকৃতিক বিপদ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবমুক্ত রাখা, উপকূলের দিকে নীতিনির্ধারণী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ, উপকূলের মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা, উপকূলের সকল সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক বিকাশের ধারা সুগম করা, উপকূলের দিকে দেশী-বিদেশী প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার নজর বাড়ানো, উপকূলের ইস্যুগুলো জাতির সামনে সহজে তুলে ধরাসহ ৭০ সালের ১২ নভেম্বরের সাইক্লোনে নিহতদের স্মরণে ‘উপকূল দিবস’ দাবি প্রাসঙ্গিক।
খাদ্য চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশই বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে দেশে; যার সিংহভাগই উপকূলে। জাতীয় অর্থনীতিতে উপকূল জিডিপির কমবেশি প্রায় ২৫ শতাংশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সমুদ্রের মৎস্য সেক্টর পুরোপুরি উপকূল কেন্দ্রিক। বাংলাদেশের কল-কারখানার পাশাপাশি উপকূলের মৎস্য সেক্টর এবং উপকূলের জনশক্তি দেশের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখছে। কিন্তু দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় গণমাধ্যমে, উপকূলের শ্রম শক্তি, মৎস্য খাত সেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না।
উপকূলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমুখী দুর্যোগের সঙ্গে বাস করেন। ঝড়-ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ এক জনপদের নামই উপকূল। বৈরী প্রতিকূলতা, জলোচ্ছ্বাস, নদী-ভাঙন, লবণাক্ততার প্রভাব নিয়ে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফেরে উপকূলের শ্রমজীবী মানুষ। তাদের জন্য একটি দিবস কী সত্যি অপ্রাসঙ্গিক!
দেশের ৭১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলের মোট ১৯টি জেলা ও ১৪৭টি উপজেলা উপকূলের অংশ। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ বাস করে উপকূলীয় অঞ্চলে। এদের জীবন-জীবিকা প্রাথমিকভাবে নির্ভর করে মাছ, কৃষি, বন, স্থানীয় পরিবহন, লবণ ইত্যাদির ওপর। এ দেশের উপকূলের জনগোষ্ঠী প্রতি বছর নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন: সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ইত্যাদির মুখোমুখি হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানবসৃষ্ট নানা রকম দুর্যোগ। যেমন: আর্সেনিক দূষণ, জলাবদ্ধতা, চাষের জমির জলাবদ্ধতা। আর এসবের সঙ্গে সংগ্রাম করেই বেঁচে আছে এ অঞ্চলের মানুষ।
উপকূলীয় এলাকার মানুষরা দেশের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিতে উপকূলীয় অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষদের ভূমিকাও কম নয়। আর এসব খেটে খাওয়া মানুষদের কথা বিবেচনা করে সরকারকে এগিয়ে আসা উচিত। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, এনজিও এবং গণমাধ্যমসহ সকলেই উপকূলের জন্য একটি দিবস প্রত্যাশা করবেন নিশ্চয়ই।
২০২০ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ কেবিনেটে উপস্থাপন করার আশ্বস্ত করেন। কিন্তু এর ফলাফল আজও নেই।
প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ৫৩ বছরে বাংলাদেশে ‘উপকূল দিবস’ দিবস পালন শুরু হলেই বিশ্বে প্রথমবারের মত এ ধরনের একটি দিবস উদ্যাপন হবে। শুধু বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই এ দিনটি ‘ওয়ার্ল্ড কোস্টাল ডে’ তথা ‘বিশ্ব উপকূল দিবস’ হওয়া উচিত। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ জানয়িছেন পটুয়াখালী জেলা প্রেসক্লাব ও পটুয়াখালী ইয়ুথ ফোরাম।